সংখ্যার ম্যাজিক

লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় graph.org.in ওয়েবসাইটে 

ভাস্কর চক্রবর্তী


কোভিড ১৯ অতিমারীর আগের এক দশক বা তারও আগের ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করে অনেকেই এটা দেখিয়েছেন যে, এটি কোনও স্বাভাবিক অতিমারী নয়, বরং এই অতিমারী নির্মাণ করা হয়েছে। যে-ভাইরাসের কারণে এই অতিমারী সেও নাকি জৈবযুদ্ধের হাতিয়ার তৈরীর ল্যাবরেটরিতে রক্ষিত ছিলো, সেখান থেকে দুর্ঘটনাক্রমে বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে বা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই বক্তব্য শুনে আমাদের মনে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে যে, তাহলে এই যে এত এত মানুষ সংক্রমিত হোলো, এত এত মানুষের মৃত্যু হোলো, এসব কীভাবে ঘটল? একি ম্যাজিক নাকি? 


আমাদের মনে হয়, এটা ম্যাজিকই। কেমন ম্যাজিক আর তাতে ম্যাজিসিয়ানের কারসাজিই বা কী তা ধরতে গেলে ম্যাজিকের পদ্ধতিকে চিরে চেলে দেখতে হয়।  


ভাইরাস ধরার ভেল্কিবাজী   


চীনের ইউহান-এ একধরণের অস্বাভাবিক নিউমোনিয়া দেখা গেল ২০১৯ সালের ১লা ডিসেম্বর। ২০২০ সালের জানুয়ারী মাসে বোঝা গেল যে এই ভাইরাস হল এক ধরণের ‘বিটা করোনা ভাইরাস’। নামকরণ হল, ‘নভেল করোনা ভাইরাস’ (nCov2019) । 


১৭ই জানুয়ারী ২০২০ – বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষনা করে দিল যে, এটি একটি নতুন ধরনের করোনা ভাইরাস আর সেই ভাইরাস চিহ্নিত করার জন্য একটি পরীক্ষা ব্যবস্থা তৈরী হওয়ার মুখে। নাম তার qRT PCR for SARS CoV2 (সংক্ষেপে ‘আরটিপিসিআর’)১। 


২১শে জানুয়ারী ২০২০ – ইউরোসার্ভেইলেন্স নামক জার্নাল-এর কাছে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র [Detection of 2019 novel Coronavirus  (2019 nCoV)  by real time RT PCR] পাঠানো হয়, যাতে দাবী করা হয় যে উপরিউক্ত পদ্ধতি দিয়ে সার্স কোভিড ২ ভাইরাস কে চিহ্নিত করা সম্ভব। এই গবেষণাপত্র লেখেন কয়েকজন বিজ্ঞানী, করম্যান এবং ড্রস্টেন নামক দুই বিজ্ঞানী তাঁদের মধ্যে প্রধান। করম্যান এবং ড্রস্টেন এর গবেষণাপত্রটি ২২শে জানুয়ারী প্রকাশ করার জন্য গৃহীত হয় এবং ২৩শে জানুয়ারী তা অন্তর্জালে প্রকাশিত হয়২। 


এখানে দু’একটা বিষয় পাঠক খেয়াল করবেন। কোনো গবেষণাপত্র কোনও জার্নালে প্রকাশ করতে গেলে তার গুনগত মান যাচাই করা হয়ে থাকে। যাচাই করা হয় স্বীকৃত একাধিক বিজ্ঞানীদের একটা কমিটি বা বোর্ড দ্বারা। এরা সম্মতি দিলে তবেই কোনো গবেষণাপত্র কোনও জার্নালে প্রকাশিত হতে পারে। এটাই সারা পৃথিবীর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় জার্নালগুলোর অভ্যাস। এর পোষাকি নাম হল পিয়ার রিভিউ (peer review) । সম্পাদকীয় দপ্তরে পাঠানোর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যে-গবেষণাপত্র গৃহীত হয়ে যায়, তার পিয়ার রিভিউ যে কীভাবে সম্ভব তা একটা রহস্য মনে হতে পারে। তবে একটা খবর জানলে এ আর রহস্য থাকে না; তা এই যে, ক্রিশ্চিয়ান ড্রস্টেন, যিনি এই গবেষণাপত্রের একজন প্রধান বিজ্ঞানী, তিনি নিজেই ছিলেন ওই জার্নালটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। 


এছাড়া আরও একটা ব্যাপার হল, এই গবেষণাপত্রটির আর একজন বিজ্ঞানী ছিলেন ওলফার ল্যন্ড, যিনি ছিলেন এক জার্মান কোম্পানীর শীর্ষ কর্তা। এই কোম্পানীর নাম হল টি আই বি মলবায়ল (TIB Molbiol)২, যারা প্রথম বরাত পেয়েছিল লক্ষ লক্ষ আরটিপিসিআর পরীক্ষার কিট তৈরী করার। তাহলে একথা কি হলফ করে বলা যায় যে গবেষণাপত্র তৈরী করার পেছনে ওলফার ল্যান্ডের বিজ্ঞান সাধনা ছাড়া অন্য কোনো স্বার্থ ছিল না? এই অন্য স্বার্থ থাকাকে বলা হয় স্বার্থের সংঘাত (Conflict of interest)। বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা প্রকাশ করতে গেলে এ’রকম কোনও ‘স্বার্থের সংঘাত’ আছে কিনা তা ঘোষনা করাটাই আন্তর্জাতিক রীতি। এই গবেষণাপত্র ছেপে বেরনোর আগে এ’রকম কোনও ঘোষণা কেউ করেননি।


আর সব থেকে বেশী যে প্রশ্নটা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে তা এই যে, গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হওয়ার আগেই কীভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জেনে গেল যে ভাইরাসটিকে চিহ্নিত করার জন্য আরটিপিসিআর পদ্ধতির ঘোষণা আসন্ন? অতএব, এই অবিশ্বাস্য গতিময় ঘটনাবলী যেকোনও লোকের মনে সন্দেহ জাগাবেই।  


সন্দেহ জেগেওছিল; সেকথা পৃথিবীর বাইশজন বিজ্ঞানী চিঠি দিয়ে ইউরোসার্ভেইলেন্স জার্নালকে জানিয়েছিলেন, ২৬শে নভেম্বর ২০২০। এই বিষয়ে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসের রিসার্চগেট জার্নালে বেরোয় তাঁদের মূল্যায়ন (review)৩। সেই মূল্যায়নে তাঁরা দেখান যে, করম্যান ও ড্রস্টেন এর ওই গবেষনাপত্র দশটি বড়সড় ভ্রান্তির শিকার, এবং সেই কারণে আরটিপিসিআর পদ্ধতিটি মোটেই সার্স কোভ ২ চিহ্নিতকরণের পক্ষে উপযুক্ত নয়। তাঁরা এও বলেন যে এই কথাটা মেনে নিলে ইতিমধ্যে মানুষের দুঃখ দুর্দশা যা হয়েছে সেখানেই রাশ টানা যাবে। তাঁরা অনুরোধ করেন, ওই জার্নাল থেকে যেন ও’রকম একটি ভ্রান্ত গবেষণাপত্র সরিয়ে দেওয়া হয়। এই চিঠির উত্তর আজও মেলেনি, এবং তাঁদের মূলয়ায়নপত্রের ভিত্তিতে সারা পৃথিবীতে কোনও সরকার বা সরকারী সংস্থা বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরটিপিসিআর পরীক্ষা পদ্ধতিকে বাতিল করেনি।  


তাহলে এই প্রশ্ন নিশ্চয়ই স্বাভাবিক যে, রোগ নির্ণয়ের জন্য একটি ভুল পদ্ধতিকে চালু করে দেওয়ার পেছনে কি আছে মানুষের মঙ্গল কামনা, বিজ্ঞান সাধনা না অন্য কিছু?  


গবেষনা পত্র সরিয়ে না হয় না নিলো। কিন্তু, কিছু সংস্থা তাদের কিছু নথিপত্রে অবিজ্ঞান বা অপবিজ্ঞান ছড়ানোর দায় থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছে বই কি! মানে ঢোঁক গিলে ঘুরিয়ে স্বীকার করেছে। যথা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি (CDC – Centre for Disease Control and Prevention)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনেকটা সময় পরে ২০২১ সালের ১৩ই জানুয়ারী, একটা নোটিশ বের করে। এতে তারা লেখে যে রোগের প্রসার যত কমবে ফলস পজিটিভ (false positive) পরীক্ষার হার তত বাড়বে৪। 


কেউ ভাবতে পারেন, ফলস পজিটিভ মানে কী? রোগ নির্ণয়ের কোনো পরীক্ষা ফলস পজিটিভ হওয়া মানে হল যে পরীক্ষা বলছে যে পরীক্ষার রিপোর্ট (ফল) পজিটিভ, কিন্তু আসলে সেই রোগ নেই (যা অন্যান্য নানা ভাবে বোঝা যায়)। তার মানে, প্রথমত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বীকার করে নিল যে, এই পরীক্ষায় ফলস পজিটিভ হওয়ার সম্ভবনা আছে। দ্বিতীয়ত, তারা এও মেনে নিল যে, যখন সংক্রমণের হার কম ছিলো, তখন যত আরটিপিসিআর পরীক্ষা হয়েছে, তাতে অনেক বেশী ফলস পজিটিভ হয়েছে, মানে তখনকার সংক্রমণের সংখ্যায় জল মিশেছে। মানে সেই জল মেশানো সংখ্যাই পরবর্তীকালে সংক্রমণ কে বেশী করে দেখিয়েছে। আর তৃতীয়ত, ফলস পজিটিভ এর হার কত হতে পারে, মানে ২% না ২০% না ৮০%, সে ব্যাপারে কিন্তু বিশ্ববাসীকে অন্ধকারে রেখে দেওয়া হল।


আর সিডিসি কি করেছিল? ২০২০ সালের ১লা ডিসেম্বর তারা একটা নথি প্রকাশ করে। সেটা হল এই আরটিপিসিআর পরীক্ষার কিট ব্যবহার করার পদ্ধতি প্রকরণ৫। এই নথির একটি অংশে তারা বলে যে, (এক) এই নব্য করোনা ভাইরাস-এর ‘আর এন এ’ পাওয়া গেলেই যে ভাইরাস পাওয়া গেল, এমনটা ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। (দুই) এমন ধরে নেওয়ারও কোনও কারণ নেই যে ‘আর এন এ’ পাওয়া গেল মানেই সার্স কোভ ২-ই রোগের কারণ। (তিন) এই পরীক্ষা পজিটিভ হওয়া মানে অন্য কোনও জীবানুর দ্বারা কোনো সংক্রমণ হয়নি, এটা ধরে নেওয়া যাবে না। (চার) রোগের প্রসার কম হলে ফলস পজিটিভ টেস্টের হার বাড়ে, এবং রোগের প্রসার বেশী হলে ফলস নেগেটিভ টেস্টের হার বাড়ে। (পাঁচ) যদি কোনো অঞ্চলে এই ভাইরাস এর মিউটেশন হয়, তাহলে এই পরীক্ষা দিয়ে নব্য করোনা ভাইরাস চিহ্নিত করা যাবে না, বা গেলেও সেই ক্ষেত্রে এই পরীক্ষার কার্য্যকারিতা হ্রাস পাবে। অর্থাৎ সিডিসি, প্রায় সোজাসুজিই মেনে নিল যে, এই টেস্ট দিয়ে এই নব্য করোনা ভাইরাসকে চিহ্নিত করা যায় না। তাহলে এর পরেও এই টেস্ট এর ভিত্তিতে অতিমারীর সংখ্যাগুলো দেখানো হচ্ছে কেন? তা কি শুধুই অতিমারীর আতঙ্ককে জিইয়ে রেখে, মানুষের ওপর নানা ধরণের নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে রাখার জন্য ? 


কোভিড ১৯ মানে এই নব্য করোনা ভাইরাস-এর আরটিপিসিআর পরীক্ষা কিভাবে হয়? যে কোনো করোনা ভাইরাস এর দুটো স্তর থাকে। একটা বাইরের আস্তরণ, স্নেহ পদার্থের তৈরী, যার মধ্যে মধ্যে কিছু প্রোটিন রয়েছে। আর একটা আছে ভেতরের অংশ, যার মধ্যে আছে সেই ভাইরাসের জিনের একটা সুতো। তাকে বলে আর এন এ (RNA)। সেই সুতোর মধ্যে অনেকগুলো জিন রয়েছে ভাইরাসের। আরটিপিসিআর পরীক্ষায় এই জিনগুলোর মধ্যে দুটো কি তিনটে জিন আছে কিনা সেটা দেখা হয়। কিন্তু এই দুটো বা তিনটে জিন পাওয়া গেলে কখনোই এটা বলা যায় না যে সার্স কোভ ২ এর সম্পূর্ণ আর এন এ আছে। আর এই ভাইরাস এর সবকটা জিন দেখা না গেলে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব প্রমান করা যায় না। সমস্ত জীবের ক্ষেত্রেই এটা সত্য। সম্পূর্ণ একটা আর এন এ বা ডি এন এ (DNA) না-পাওয়া গেলে কখনোই সেই জীবের অস্তিত্ব প্রমানিত হয় না। যে দুটো বা তিনটে জিন এর ওপর পরীক্ষা হয়, সেগুলো যে সার্স কোভ ২ ছাড়া অন্য করোনা ভাইরাস এ পাওয়া যায়না, একথাও হলফ করে বলা যায় না। সেই সব করোনা ভাইরাস আবার বহুদিন ধরেই জনমানুষের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছে। তার মানে, সার্স কোভ ২ চিহ্নিত করতে গিয়ে এই আরটিপিসিআর পরীক্ষা যে অন্য করোনা ভাইরাস চিহ্নিত করে বসছে না, তার কোনও ঠিক নেই। তাহলে এই এত এত সংখ্যা কিসের, সেই প্রশ্ন কি উঠবে না এবার ? 


সে যাই হোক, আমরা আর একটু তলিয়ে দেখি। এই আরটিপিসিআর পরীক্ষা এই দুটো বা তিনটে জিন এর অস্তিত্বই বা প্রমাণ করে কীভাবে? একটা বা দুটো বা তিনটে জিন মাইক্রস্কোপেও দেখা তো যায় না! এই পরীক্ষা এই জিনগুলোকে পুনরুৎপাদন করতে থাকে, প্রতি বারে (বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে সাইক্ল) জিনগুলো ডবল হয়ে যায়। দশ লক্ষ জিন হলে তখন এর অস্তিত্ব ধরা যায়। একটা থেকে দশ লক্ষ জিন হতে কুড়ি বার ডবল করতে হয়। কুড়িটা সাইক্ল। কিন্তু যদি আপনার হাতে গোটা একটা জিনও না থাকে তাহলেও আপনি আরো বেশী সাইক্ল ডবল করলে জিনের অস্তিত্ব ধরা যাবে। সারা পৃথিবীর বহু বিজ্ঞানী এই নিয়ে কাজ করেছেন এবং তারা এই সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে ২৮ টার বেশী সাইক্ল ডবল করা উচিত নয়, আর ৩০ টার বেশী যদি করতে হয় তাহলে ধরে নিতে হবে যে পরীক্ষা ভুল হচ্ছে৬,৭। তার মানে এই বেশী সাইক্ল করার অর্থ হল ফলস পজিটিভ বেশী হওয়া।  


এবার আসি আমাদের দেশের সরকারের কাণ্ডকারখানায়। ১২ই এপ্রিল (২০২১) দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া তে খবর বেরোয় যে তার এক সপ্তাহ আগে নাকি মহারাষ্ট্র সরকার আই সি এম আর কে অনুরোধ করেছিল এই সাইক্ল এর সংখ্যা (সাইক্ল থ্রেসহোল্ড বা সিটি ভ্যাল্যু) ২৪ এ রাখার জন্য। কিন্তু আই সি এম আর তাঁদের জানিয়ে দেন যে ৩৫ এর কম সিটি ভ্যাল্যু রাখা উচিত নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই সিটি ভ্যাল্যুর কোনও আন্তর্জাতিক মান স্থির করা নেই। অন্তত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করেনি। সিডিসি ৩৫ থেকে ৪০ এর মতো সিটি ভ্যাল্যু থাকলেও সেই পরীক্ষাকে সঠিক বলে মেনে নেয়। পরীক্ষার কিট তৈরী করার একেক সংস্থা একেক সিটি ভ্যাল্যু ঠিক করে রাখে। তাহলে কি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সিডিসি বা আই সি এম আর বা আমাদের দেশের সরকারের কোনও স্বার্থ আছে, এই সিটি ভ্যাল্যু বেশী রাখার পেছনে। ফলস পজিটিভ বেশী বেশী করে দেখানোর পেছনে ?   


আর আমার আপনার পক্ষে ব্যাপারটা কীরকম দাঁড়ালো ? এই পরীক্ষা কি বিশ্বাসযোগ্য ? এই পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে আপনি ১৪ দিন কি ২১ দিন নিজেকে অবরুদ্ধ করে রাখবেন, এর ভিত্তিতে আপনি লকডাউন মেনে নেবেন? এর ভিত্তিতেই আপনি এই প্যানডেমিকের আতঙ্কে সিঁটিয়ে থাকবেন আর রাষ্ট্রকে যা ইচ্ছে তাই করে যাওয়ার অধিকার দেবেন? মানে জনমানুষকে অবরুদ্ধ করে রাখার অধিকার, দেশের সরকারের সম্পদ যা কিনা আসলে মানুষের সম্পদ তা বিদেশী বা তাঁদের দালালদের হাতে তুলে দেওয়ার অধিকার, কৃষকদের ভাতে মারার অধিকার, শ্রমিকদের ভাতে মারার অধিকার, শিশু এবং অন্যান্য শিক্ষার্থীদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করার অধিকার ? চিকিৎসকদের চিকিৎসা শাস্ত্রের বুনিয়াদ ভুলিয়ে দেওয়ার অধিকার? 


চিকিৎসা বিদ্যার উলট পুরাণ  


চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রাচীন কালে মনে করা হত যে জীবাণু ঘটিত রোগগুলোর জন্য একমাত্র সেই জীবাণুই দায়ী। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এটা বোঝা গেল যে যেকোনও জীবাণু সংক্রমণ হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তে গেলে তিন ধরনের কারণকে একই সঙ্গে একই ব্যক্তির দেহে কাজ করতে হয়। (১) রোগের প্রতিনিধি বা জীবাণু, (২) অসুস্থ ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা অর্থাৎ সেই ব্যক্তির সাধারণ এবং বিশেষ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, (৩) পরিবেশগত কারণ, অর্থাৎ অসুস্থ ব্যক্তি যে পরিবেশে আছেন সেই পরিবেশে সেই জীবাণু বেঁচে থাকতে এবং বংশবৃদ্ধি করতে পারে কিনা। তার মানে, শরীরে কিছু জীবাণু ঢুকে পড়লেই মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে না। জীবাণুর পরিমাণ এমন হতে হবে যাতে মানুষ অসুস্থ হয়। আবার, সেই মানুষের যদি স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পর্যাপ্ত থাকে তাহলে সে অসুস্থ নাও হতে পারে। পরিবেশগত কারণ বলতে সাধারণভাবে বোঝায় যে, একটা বিশেষ উত্তাপ, আর্দ্রতা এবং অক্সিজেন থাকা বা না থাকার ওপর নির্ভর করে জীবাণু বেঁচে থাকতে এবং বংশবৃদ্ধি করতে পারবে কিনা। এ-ব্যাপারে এক-একটা জীবাণুর এক-একরকম বৈশিষ্ট্য থাকে। 


অর্থাৎ এই তিন ধরনের কারণগুলো সব এক ব্যক্তির দেহে মিলে গেলে তবেই সেই ব্যক্তি জীবাণুর দ্বারা রোগাক্রান্ত হবেন, নাহলে নয়। 


এই প্যানডেমিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের আবার পিছিয়ে দিল প্রায় এক শতক, জলাঞ্জলি দিল এই অধীত বিদ্যাকে, বিজ্ঞানকে। তারা বলল যে আরটিপিসিআর পরীক্ষা পজিটিভ মানেই তাকে রোগ বলে ধরতে হবে।৮ অথচ চিকিৎসা বিজ্ঞানে আমাদের হাতেখড়ি হয় এটা পড়ে যে, সংক্রমণ মানেই রোগ নয়। প্রতিটি সংক্রমণকে রোগ বলে ধরে নিলে গণ মননে রোগের বিষয়ে আতঙ্ক তৈরী হয়।  


“কোভিড মৃত্যু”র নিদান  


তারা (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) আরো কিছু বলল, কোভিডে মৃত্যু নিয়ে। আমরা দেখেছি যে এই করোনা কালে যে কোনও মানুষ যে কোনও হাসপাতালে ভর্তি হতে গেলেই আরটিপিসিআর পরীক্ষা করাতে হচ্ছে। সেই মানুষটি হাসপাতালে মারা গেলে এই আরটিপিসিআর পরীক্ষার রিপোর্ট রাষ্ট্রের হাতে এক অস্ত্র হয়ে উঠছে। যদি এই পরীক্ষা পজিটিভ হয়, তাহলে তার শ্বাসতন্ত্রের কোনও উপসর্গ থাক আর নাই থাক, অন্য কোনও রোগ থাক আর নাই থাক (এমনকি ক্যান্সারও), তার মৃত্যুর কারণ লিখতে হবে, ‘কোভিড ১৯’। পরীক্ষা হয়তো নেগেটিভ, কিন্তু যদি কোভিডের উপসর্গ থাকে তাহলেও মৃত্যুর কারণ হবে, কোভিড ১৯। অথচ এই অসুখটির আলাদা কোনও বিশেষ উপসর্গ নেই। এই রোগের যা উপসর্গ সেগুলো শ্বাসতন্ত্রের অন্যান্য ভাইরাসের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। তার অর্থ দাঁড়ালো এই যে, অন্য কোনও ভাইরাসের সংক্রমণ থাকলেও, কোভিডের উপসর্গ বলে সেই মৃত্যুকে কোভিড মৃত্যু লিখতে হবে। এমনকী, পরীক্ষার রিপোর্ট যদি এসে না পৌঁছে থাকে, তাহলেও সেই মৃত্যুকে কোভিড ১৯ এ মৃত্যু হিসেবে সন্দেহের তালিকায় রাখতে হবে। আর রিপোর্ট যদি অনির্দিষ্ট হয়, তাহলেও সেই মৃত্যুকে বলতে হবে বোধহয় কোভিড ১৯ এর জন্য৮,৯। অর্থাৎ, তাদের পরামর্শ অনুযায়ী পৃথিবীতে শ্বাসতন্ত্রের সঙ্গে সম্বন্ধ আছে এমন প্রায় যেকোনো মৃত্যুকেই কোভিড ১৯ এর জন্য বলে ধরে নিতে হবে। 


অতিরাষ্ট্রের এই দুই নিদান আমাদের দেশের সরকার এবং সরকারী সংস্থা মাথা পেতে নিল এবং চাপিয়ে দিল মানুষের ঘাড়ে। তারই ফলে “কোভিডে মৃত্যু”র সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে গেল। আর সেই সংখ্যাকেও গোয়েবলসীয় পদ্ধতিতে মিডিয়া এমনভাবে পরিবেশন করে চলেছে যে সংবাদপত্র পড়লেই মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরী হচ্ছে। এক সংবাদ মাধ্যমের নামই তো হয়ে গেল “_ _ _ আতঙ্ক”। এরকম পদ্ধতি অনেক। তার মধ্যে একটা হল, কোনও বিশেষ সময়ের মধ্যে (সপ্তাহ, মাস বা বছর) হিসেব না দেখিয়ে ২০২০ সালের জানুয়ারী থেকে সে তাবৎ যত পজিটিভ পরীক্ষা, আর তার মধ্যে যত মৃত্যু সব মিলিয়ে শুধু সংখ্যাটাকে বড় করে প্রচার করা। এসব হল, আতঙ্ক নির্মাণের গন মনস্তাত্ত্বিক কায়দা।  


কিন্তু এত চেষ্টা করেও, এত জল মিশিয়েও, কোভিডের সংখ্যার হিসেব কি বলছে? ১৯ই অগাস্ট, মধ্য ইয়োরোপের সময়ে সন্ধ্যা ৬টা অবধি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ড্যাশবোর্ড১০ দেখে এই তথ্য দিচ্ছি। সারা পৃথিবী ব্যাপী কোভিড ১৯ রোগের কেস ফ্যাটালিটি রেশিও (অর্থাৎ নির্দিষ্ট রোগ এবং মৃত্যুর অনুপাত) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্যের হিসেবেই দাঁড়াচ্ছে ২.০৯৮%। আর ভারতে তা দাঁড়াচ্ছে ১.৩৩৯%। আর যা দিয়ে রোগের ভয়াবহতা জনস্বাস্থ্যের ব্যবস্থাতে সাধারণত মাপা হয়, তাকে বলা হয় ইনফেকশন ফ্যাটালিটি রেশিও। সারা বিশ্বে এই রেশিও ০.৫% থেকে ১.০%১০,১১। এইবার যদি জল থেকে আসল তথ্য ছেঁকে তোলা হয় তাহলে সংখ্যা ঠিক কতটুকু দাঁড়াবে তা নিশ্চয়ই পাঠক অনুমান করতে পারবেন। 


এই হল, ম্যাজিসিয়ানের ম্যাজিক দেখানোর কৌশল। এখন কথা হল, এই ম্যাজিকের ফলাফল কী, এতে কার কত লাভ কার কত লোকসান? সেই হিসেব পাঠক নিজেই করে নিন। 


তথ্যসূত্র – 


১। Laboratory Testing for 2019 novel corona virus (2019 nCoV) in suspected human cases – WHO Interim Guidance, 17 January 2020. 


২। Detection of 2019 novel corona virus (2019 nCoV) by real time RT PCR ;  Victor M Corman¹, Olfert Landt², Marco Kaiser³, Richard Molenkamp⁴, Adam Meijer⁵, Daniel KW Chu⁶, Tobias Bleicker¹, Sebastian Brünink¹, Julia Schneider¹, Marie Luisa Schmidt¹, Daphne GJC Mulders⁴, Bart L Haagmans⁴, Bas van der Veer⁵, Sharon van den Brink⁵, Lisa Wijsman⁵, Gabriel Goderski⁵, Jean-Louis Romette⁷, Joanna Ellis⁸, Maria Zambon⁸, Malik Peiris⁶, Herman Goossens⁹, Chantal Reusken⁵, Marion PG Koopmans⁴, Christian Drosten¹ ; www.eurosurveillance.org ; 23 January 2020;  


[1. Charité – Universitätsmedizin Berlin Institute of Virology, Berlin, Germany and German Centre for Infection Research (DZIF), Berlin, Germany 2. Tib-Molbiol, Berlin, Germany 3. GenExpress GmbH, Berlin, Germany* 4. Department of Viroscience, Erasmus MC, Rotterdam, the Netherlands 5. National Institute for Public Health and the Environment (RIVM), Bilthoven, the Netherlands 6. University of Hong Kong, Hong Kong, China 7. Universite d Aix-Marseille, Marseille, France 8. Public Health England, London, United Kingdom 9. Department of Medical Microbiology, Vaccine and Infectious Diseases Institute, University of Antwerp, Antwerp, Belgium 

Correspondence: Christian Drosten  - christian.drosten@charite.de]  


৩। Review Report - Corman-Drosten et al., Eurosurveillance 2020, External peer review of the RTPCR test to detect SARS-CoV-2 reveals 10 major scientific flaws at the molecular and methodological level: consequences for false positive results;  Pieter Borger, Rajesh K. Malhotra, Michael Yeadon, Clare Craig, Kevin McKernan, Klaus Steger, Paul McSheehy, Lidiya Angelova, Fabio Franchi, Thomas Binder, Henrik Ullrich, Makoto Ohashi, Stefano Scoglio , Marjolein Doesburg-van Kleffens Dorothea Gilbert , Rainer J. Klement , Ruth Schruefer , Berber W. Pieksma , Jan Bonte , Bruno H. Dalle Carbonara , Kevin P. Corbett , Ulrike Kämmerer ; ResesrchGate ; https://www.researchgate.net/publication/346483715 ; November 2020.  


৪। Information Notice for IVD Users 2020/05:  Nucleic acid testing (NAT) technologies that use polymerase chain reaction (PCR) for detection of SARS-CoV-2 ; WHO ; 13 January 2021 


৫। CDC 2019-Novel Coronavirus (2019-nCoV) Real-Time RT-PCR Diagnostic Panel: Instructions for Use [Catalog # 2019-nCoVEUA-01 1000 reactions] – [CDC-006-00019, Revision: 06 CDC/DDID/NCIRD/ Division of Viral Diseases Effective: 12/01/2020]  


৬। https://graph.org.in/en/expert-speak/24-web-discussion-prof-bhakdi-2july2021.html  


৭। Viral cultures for COVID-19 infectivity assessment – a systematic review (Update 4) ; Jefferson T, Spencer EA,  Brassey J, Heneghan C, in Analysis of the Transmission Dynamics of COVID-19: An Open Evidence Review; medRxiv; September 29, 2020;  


[medRxiv preprint doi: https://doi.org/10.1101/2020.08.04.20167932; this version posted September 29, 2020. The copyright holder for this preprint (which was not certified by peer review) is the author/funder, who has granted medRxiv a license to display the preprint in perpetuity. It is made available under a CC-BY-NC-ND 4.0 International license.] 


৮। https://www.who.int/classifications/icd/COVID-19-coding-icd10.pdf  


৯। Medical certification, ICD mortality coding, and reporting mortality associated with COVID-19: Technical note: WHO : 7 June 2020 [ https://www.who.int/publications-detail-redirect/WHO-2019-nCoV-mortality-reporting-2020-1 ]  


১০। https://covid19.who.int/  


১১। Estimating Mortality from COVID 19: Scientific Brief: WHO: 4 August 2020

Comments

Popular posts from this blog

The Backdrop of The Pandemic – A Note

জিন সাম্রাজ্যবাদ

Vaccination, Rising Deaths, And The False Narrative